পোঁ-ও-ও-ও শব্দ তুলে পানিতে চলতে শুরু করে লঞ্চটা। বরিশাল থেকে ভোলার উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি। লঞ্চের ডেকে দাঁড়াতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে লাগলো আমার মুখে। এমন চমৎকার পরিবেশেও মনটা খচখচ করতে থাকে। খুব সমস্যা না হলে মুহিনটাকে ছেড়ে একটা দিনও বাইরে থাকি না। হঠাৎ দূরের আকাশে একটা চিল উড়ে যায়। পানি কেটে এগিয়ে চলে লঞ্চ। ডেকের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুহিনের কথাই ভাবতে থাকি আমি। মানুষের কোলাহল আর লঞ্চের একঘেয়ে শব্দ ভুলে যাই। কানে বাজে মুহিনের বাক-বাকুম বাক-বাকুম ডাকের শব্দ!
হঠাৎ একটা শোরগোল পড়ে যায়, একটা কবুতর এসে লঞ্চের রেলিং’র উপর দাড়িয়ে ডাকতে থাকে, তা দেখে মানুষ বলতে থাকে আরে, আরে! এই কবুতরটি এল কোথা থেকে? আমি তাদের কোলাহল শুনে এগিয়ে যেতেই দেখি আমার মুহিন, আমি অবাক চোখে ওর দিগে তাকাতেই ও আমার কাধে আসে। তখন মানুষগুলো আরো অবাক হয়ে বলে, কবুতরটা কোথা থেকে আসলো? তাও আবার আপনার কাঁধে কেন? আমি কী আর বলবো, সবার মতো আমিও বিস্মিত! অগনিত জিজ্ঞাসু চোখ আমি আর আমার প্রিয় পায়রা মুহিনকে দেখতে থাকি। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই মুহিনকে হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কিরে, তুই কেমন করে জানলি আমি লঞ্চে?’ পায়রা মুহিন কী বোঝলো কে জানে! মাথা ঘষতে থাকে আমার বুকে। বাক-বাকুম করে ডেকে ওঠে আনন্দে! যেন খানিক আগে হারিয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা তার বাবার কোলে ফিরে এল আবার!
এটা গল্প নয়, আমার পায়রা মুহিনকে নিয়ে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা। আমি রেজাউল কবির, বরিশাল অভিরুচি কমপ্লেক্স’র ব্যবস্থাপক। সেই ১৩ বছর বয়স থেকেই পায়রা পুষতে শুরি করি আমি। ১৫ বছরে অনেক পায়রাই ঘরে এসেছে আবার উড়েও গেছে। ১১ বছর আগে ডিম ফুটে এক জোড়া বাচ্চা বের হওয়ার পর পরই বাচ্চাদের মা-বাবা মরে যায়। গল্পের শুরু তখন থেকেই। কয়েক দিনের মাথায় দুই বাচ্চার মধ্যে একটা বাচ্চা তার মা-বাবার পথ অনুসরণ করে। একা হয়ে যায় বেঁচে থাকা বাচ্চাটা। নিজে থেকে খেতে পারে না। হাঁটতে পারে না। শরীরে তেমন পালকও গজায়নি যে শীতের হাত থেকে রেহাই পাবে। তখন আমার মায়া পড়ে যায় ঐ বাচ্চাটার ওপর। নিজের হাতে নিয়ম করে খাওয়ানো, প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা সবই করতে থাকি ওর মায়ের মতো। বাচ্চাটাও ভুলে যায় তার হারানো মায়ের অভাব। আর দশটা ছোট ছেলেপুলের মতোই আমার হাতে খাবার খাওয়া, আদর নেওয়ায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ে দিনে দিনে। এভাবেই একসময় মা-বাবা হারা ছোট্ট বাচ্চা পায়রাটির শরীরে পালক গজায়। ডানায় শক্তি আসে। চিঁচিঁ শব্দ ছেড়ে কুব কুব করে ডেকে ওঠে সময়ে-অসময়ে। আমার চোখ তখন চিকচিক করে ওঠে, বুকে আনন্দের ঢেউ। একদিন ভেবেচিন্তে একটা নামও ঠিক করি পায়রাটার। ওর নাম দেই মুহিন।
খাবার খাওয়ানো, ঘুমানো, ময়লা পরিষ্কার সবই তো হলো। একটা মা-পাখির বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বাচ্চাকে উড়তে শেখানো। তখন আমি সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। প্রথমে বাড়ির ছাদে, পরে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে চলতে থাকে ওড়াউড়ির তালিম। ওড়াউড়িটা আয়ত্তে এলে শুরু হয় নানা প্রশিক্ষণের বিচিত্র কসরত। ডিগবাজি, নাম ধরে ডাকলে কাছে ছুটে আসা, কোথাও যেতে বললে ঠিক ঠিক সেখানেই ছুটে যাওয়া এসবই। খুব ভালো ছাত্রের মতোই সবকিছু ঠিকঠাক শিখে ফেলে মুহিন। পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ে তার কীর্তিত্বের কথা। একসময় পাড়া ছাড়িয়ে পুরো বরিশাল শহরে মুহিন নামটা মুখে মুখে ফেরে। তার আজব কীর্তি দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। গর্বে বুক ফুলে ওঠে আমার। তবে সাধের শান্তির পায়রার কারণে ঘরে অশান্তি নেমে আসে একসময়। আমার স্ত্রী ফারজানার চোখের কাঁটা হয় মুহিন। সারাটা দিন ঘরের এখানে-সেখানে পায়খানা করলে কিংবা কাজের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটালে কারই বা ভালো লাগে তা! এ নিয়ে টুক টাক ঝগড়া লেগেই থাকত আমার আর ফারজানার মধ্যে।
আমার এক কথা, মুহিন আমার বিছানাতেই ঘুমাবে, আমার সঙ্গেই খাবে আর আমার সঙ্গেই ঘুরবে। ফারজানাও রেগে জানিয়ে দেন, মুহিনকে আর অন্য সব পায়রার সঙ্গেই রাখতে হবে; ঘরে জায়গা নেই তার।
কিন্তু একদিন তাঁর সেই রাগও জল হয়ে যায়। আমার এক ডাকে মুহিন যখন কাঁধে এসে বসে, মুগ্ধ চোখে তাকায় আমার স্ত্রী । মিটমাট হয়ে যায় আমাদের খুনশুটি ঝগড়া!
এখন বরিশাল শহরে মুহিনকে এক নামেই চেনে সবাই। আমার চেয়েও মুহিন এখন বেশি পরিচিত, শুধু বরিশাল নয়, মিডিয়ার কারনে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এখন মুহিন! ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করি আমি। যেখানেই যাই মাথার ওপর দিয়ে চলে মুহিন। খেতে বসলে পাশে বসে খাবার খুঁটে খুঁটে খায় সে। সকালে মশারির ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে আমার বুকের কাছে, চুপ করে বসে থাকে। ঠোঁট ঘষে, বাক-বাকম শব্দ করে আমার কাছে নিজের সন্তানের মতোই আদর চায় মুহিন।