কবুতরের ইতিকথা

কবুতর বা পায়রা, কপোত বা পারাবত এক প্রকারের জনপ্রিয় বুদ্ধিমান গৃহপালিত পাখি। শান্তির পায়রা হিসাবে এর মর্যাদা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে শান্তির পায়রা অবমুক্ত করে (আকাশে উড়িয়ে) অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়। এরা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম। তাই বারবার দূর-দূরান্তে গিয়েও নিজ ঠিকানায় ফিরে আসতে এদের অসুবিধা হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা যুদ্ধক্ষেত্রে বার্তা পাঠাতে কবুতরকে ব্যবহার করেছেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত উড়িষ্যা পুলিশের পিজন সার্ভিস ছিল। প্রাচীনকালে কবুতরের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান করা হতো। কবুতর ওড়ানোর প্রতিযোগিতা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে। বিভিন্ন রং, বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, চোখের রঙ ও আকৃতির উপর ভিত্তি করে কবুতরের নামকরণ বা জাত ঠিক করা হয়। এদের সচরাচর জাতগুলো হলোঃ হোমার বা হোমিং পিজিয়ন, দেশি কবুতর গোলা, ভারতীয় জাতের লাক্ষা,  সৌখিন সিরাজী. গিরিবাজ, ‘কাগজি’, চিলা, গোররা, চুইনা, রান্ট, প্রিন্স, পটার, ফ্রিল ব্যাক, জ্যাকোবিন, স্ট্রেসার, মডেনা, মুসল দম, নোটন ও  কিং।
মোঘল আমলে ঘুড়ি যেমন উড়ত, কইতরবাজিও সেইরূপ চলত। প্রাসাদের মেয়েরাও কবুতর ওড়ানোয় দক্ষ ছিল। ঢাকার নবাবদেরও এ শখ ছিল। কবুতরকে (জালালী কবুতর) ঘিরে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অনেক কাহিনী আছে। বিভিন্ন তথ্যমতে—যোগাযোগ, গোয়েন্দাকর্ম, বস্তু ও ব্যক্তি শনাক্তকরণ ইত্যাদি কাজে পশু-পাখিদের ব্যবহার অতি প্রাচীন। এ সমপর্কে নানা ধরনের রূপকথা, উপকথা ও ঐতিহাসিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পশু-পাখিদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে কবুতর। এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন ঘটনাটি হযরত নূহ (আ:) এর সময়কালে পৃথিবীতে যখন প্রবল বন্যা শুরু হয়, তখন তিনি একটি নৌকায় জোড়ায় জোড়ায় সকল প্রাণী উঠিয়ে ও তার অনুসারীদের নিয়ে একটি পর্বতে আশ্রয় নেন। অনেক দিন হয়ে গেলে বন্যার পানি নেমে গেছে কিনা তা জানার জন্য সমতলে একটি কবুতর প্রেরণ করা হয়। কিছুদিন সমতল পর্যবেক্ষণ করে কবুতরটি আবার নূহের কাছে ফিরে আসে। সমতলে ফেরা নিরাপদ তা বোঝানোর জন্য সংবাদ বাহক কবুতর তার ঠোঁটে করে একটি জলপাই ডাল নিয়ে আসে। একাদশ শতকে বাগদাদে কবুতরকে খবর আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। চেঙ্গিস খাঁ কবুতরের মাধ্যমে তার বিশাল রাজ্যের খবর আদান প্রদান করতেন। কবুতরকে সংবাদ বাহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার করা হয় যুদ্ধকালীন সময়ে। ১৮৭০-৭১ খৃষ্টাব্দে প্রাসিয়ার যুদ্ধে প্যারিসের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কবুতর ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কবুতরের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া আমেরিকান ব্যাটালিয়নের সন্ধান ‘চারআমি’ নামের একটি সংবাদবাহক কবুতরের দ্বারা পাওয়া যায়। এ কারণে চারআমি কবুতর রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধের সময় সংবাদ আদান প্রদানের বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য সৈন্যদের পাশাপাশি তাই কবুতরদেরও সম্মানসূচক ব্যাজ বা উপাধি দেয়া হতো।
১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ-ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর পক্ষে শুধু কবুতর পরিচালনার জন্য প্রায় ৯০ হাজার লোক নিয়োজিত থাকত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও কবুতর পরিচালনাকারীর সংখ্যাও ছিল অনুরূপ। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য পুলিশের কাজে কবুতরের ব্যবহার করার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। তবে সারা বিশ্বের সকল কবুতরের তুলনায় অতি নগণ্য সংখ্যক কবুতর দ্বারা মানব প্রদত্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব বার্তা-বাহকের কাজ করানো সম্ভব হয়েছে।
পৃথিবীতে কবুতরের প্রায় সহস্র প্রকার জাত রয়েছে। সকল প্রকারের কবুতর পুলিশি কাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়। সাধারণত হোমার জাতীয় কবুতর তথ্য আদান প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হয়। এসব কবুতরের ডানা মাংসল ও শক্ত। এরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে এবং তার বাসস্থল থেকে ১৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে ফেরত আসতে পারে। কবুতরের বাচ্চার বয়স ৪২ দিন হলেই তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করা হতো। প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে এক কিঃ মিঃ দূরে, পরে দুই কিঃমিঃ এবং ক্রমান্বয়ে ১০০-২০০ কিলোমিটার দূরে ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে ক্রমাগত দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেও যখন প্রশিক্ষণার্থী কবুতর নির্ভুলভাবে নিজ খোপে ফিরে আসতে পারে তখন তাদের দূরপাল্লার তথ্য পরিবহনের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। দূরপাল্লার গন্তব্য প্রেরণের জন্য, কবুতরগুলোর পায়ে বিশেষভাবে তৈরি প্লাস্টিকের কৌটায় সংক্ষিপ্ত আকারে পত্র লিখে কাগজ ভাঁজ করে পুরে দেয়া হয়। এই কবুতর দুটো বাচ্চা উত্পাদনের জন্য জুটি। এমন জুটি বা যুগলকে একই সাথে একই তথ্যসহ গন্তব্যে প্রেরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্যে হলো এতে বিপরীত লিঙ্গের অপরিচিত কবুতর সংবাদ বাহককে প্রলুব্ধ করতে পারবে না; একটি কবুতর পথ ভুল করলে অন্য কবুতর পথ চিনিয়ে দিতে পারবে; পথে কোন বাধা এলে যৌথভাবে তা মোকাবেলা করতে পারবে এবং কোন কারণে একটি কবুতর নিরুদ্দেশ হলেও অন্যটি সংবাদ পরিবহনের কাজটি শেষ করতে পারবে।
বুমেরাং পদ্ধতিতে এক জোড়া কবুতরকে ছেড়ে দেয়া হলে তারা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। উড়িষ্যার কোন থানা থেকে কোন কবুতর জেলা সদরে সংবাদ নিয়ে এলে তারা জেলা সদরে স্থাপিত খোপে এসে প্রবেশ করে। খোপের দুইটি কুঠরি থাকে। উপরের কুঠরিতে প্রবেশ করার পর তারা দ্রুত নিচের কুঠরিতে প্রবেশ করে। নিচের কুঠরিতে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া থাকে। সংবাদ বাহক কবুতর প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়। এরা গন্তব্যের খোপে এসেই খাবার খেতে শুরু করে। এরই ফাঁকে কবুতর পরিচালনাকারী পুলিশ সদস্য কবুতরের পায়ে বাঁধা কৌটা থেকে খবর সংগ্রহ করে। প্রয়োজনে নতুন খবর ভর্তি কৌটা পুনরায় কবুতরের পায়ে বেঁধে দেয়। সে খবর নিয়ে তারা নিজ খোপে ফিরে আসে। এখনও ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য পুলিশেই কবুতরকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *