প্রথম আলো (শখের দুনিয়া)

সাইফুর রহমান //

   

পোঁ-ও-ও-ও শব্দ তুলে পানিতে সাঁতরাতে শুরু করে লঞ্চটা। বরিশাল থেকে ভোলার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন রেজাউল কবির। লঞ্চের ডেকে দাঁড়াতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে তাঁর মুখে। এমন চমত্কার পরিবেশেও মন খচখচ করে তাঁর। খুব সমস্যা না হলে মুহিনটাকে ছেড়ে একটা দিনও বাইরে থাকেন না তিনি। দূরের আকাশে একটা চিল উড়ে যায়। পানি কেটে এগিয়ে চলে লঞ্চ। ডেকের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুহিনের কথাই ভাবতে থাকেন রেজাউল। মানুষের কোলাহল আর লঞ্চের একঘেয়ে শব্দ ভুলে যান তিনি। কানে বাজে মুহিনের বাক-বাকুম বাক-বাকুম বোল!
হঠাত্ একটা শোরগোল পড়ে যায়। আরে, আরে! এই কবুতর এল কোত্থেকে? তাও আবার আপনার কাঁধে! রেজাউল আর কী বলবেন, নিজেই তো আর সবার মতোই বিস্ময়াভিভূত! অগুনতি জিজ্ঞাসু চোখ রেজাউল আর তাঁর প্রিয় পায়রা মুহিনকে দেখতে থাকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই মুহিনকে হাতে তুলে নিয়ে রেজাউল জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে, তুই কেমন করে জানলি আমি লঞ্চে?’ পায়রাটা কী বোঝে কে জানে! মাথা ঘষতে থাকে তাঁর বুকে। বাক-বাকুম করে ডেকে ওঠে আনন্দে! যেন খানিক আগে হারিয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা তার বাবার কোলে ফিরে এল আবার!
গল্পটা সত্যি। রেজাউল কবির, বরিশালের রয়েল রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক। সেই ১৩ বছর বয়স থেকেই পায়রা পুষতে শুরু করেছিলেন। ১৫ বছরে অনেক পায়রাই তাঁর ঘরে এসেছে আবার উড়েও গেছে। দেড় বছর আগে, ডিম ফুটে এক জোড়া বাচ্চা বের হওয়ার পর পরই এক মা পায়রা মরে যায়। গল্পের শুরু তখন থেকেই। কয়েক দিনের মাথায় দুই বাচ্চার মধ্যে একটা বাচ্চা তার মায়ের পথ অনুসরণ করে। একা হয়ে যায় বেঁচে থাকা বাচ্চাটা। নিজে থেকে খেতে পারে না। হাঁটতে পারে না। শরীরে তেমন পালকও গজায়নি যে শীতের হাত থেকে রেহাই পাবে। রেজাউলের বিশেষ মায়া পড়ে যায় বাচ্চাটার ওপর। নিজে হাতে নিয়ম করে খাওয়ানো, প্রয়োজনীয় তাপের ব্যবস্থা—সবই করতে থাকেন নিজের মায়ের মতো। বাচ্চাটাও ভুলে যায় তার হারানো মায়ের অভাব। আর দশটা ছোট ছেলেপুলের মতোই রেজাউলের হাতে খাবার খাওয়া, আদর নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে দিনে দিনে। এভাবেই একসময় মা-হারা ছোট্ট বাচ্চা পায়রাটির শরীরে পালক গজায়। ডানায় শক্তি আসে। চিঁচিঁ শব্দ ছেড়ে কুব কুব করে ডেকে ওঠে সময়ে-অসময়ে। রেজাউলের চোখ তখন চিকচিক করে ওঠে, বুকে আনন্দের ঢেউ। একদিন ভেবেচিন্তে একটা নামও ঠিক করে ফেলেন পায়রাটার—মুহিন।
খাবার খাওয়ানো, ঘুমানো, ময়লা পরিষ্কার—সবই তো হলো। একটা মা-পাখির বড় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বাচ্চাকে উড়তে শেখানো। রেজাউল কবির সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবার। প্রথমে বাড়ির ছাদে পরে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে চলতে থাকে ওড়াউড়ির তালিম। ওড়াউড়িটা আয়ত্তে এলে শুরু হয় নানা প্রশিক্ষণের বিচিত্র কসরত। ডিগবাজি, নাম ধরে ডাকলে কাছে ছুটে আসা, কোথাও যেতে বললে ঠিক ঠিক সেখানেই ছুটে যাওয়া—এসবই। খুব ভালো ছাত্রের মতোই সবকিছু ঠিকঠাক শিখে ফেলে মুহিন। পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ে তার কীর্তির কথা। একসময় পাড়া ছাড়িয়ে পুরো বরিশাল শহরে মুহিন নামটা মুখে মুখে ফেরে। তার আজব কাণ্ড-কীর্তি দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। গর্বে বুক ফুলে ওঠে রেজাউল কবিরের। তবে সাধের শান্তির পায়রার কারণে ঘরে অশান্তিই নেমে আসে একসময়। রেজাউলের স্ত্রী ফারজানার চোখের কাঁটা হয় পায়রাটা। সারাটা দিন ঘরের এখানে-সেখানে পায়খানা করলে কিংবা কাজের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটালে কারই বা ভালো লাগে তা! এ নিয়ে খুটখাট ঝগড়া লেগেই থাকত রেজাউল আর ফারজানার মধ্যে।
রেজাউলের কথা—মুহিন আমার বিছানাতেই ঘুমাবে, আমার সঙ্গেই খাবে আর আমার সঙ্গেই ঘুরবে। ফারজানাও রেগে জানিয়ে দেন, মুহিনকে আর অন্য সব পায়রার সঙ্গেই রাখতে হবে; ঘরে জায়গা নেই তার।
কিন্তু একদিন তাঁর সেই রাগও জল হয়ে যায়। রেজাউলের এক ডাকে মুহিন যখন তাঁর কাঁধে এসে বসে, মুগ্ধ চোখে তাকান ফারজানা। মিটমাট হয়ে যায় তাঁদের খুটখাট ঝগড়া!
এখন বরিশাল শহরে মুহিনকে এক নামেই চেনে সবাই। রেজাউলের চেয়েও বেশি পরিচিত তার নাম! ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করেন তিনি। যেখানেই যান মাথার ওপর দিয়ে চলে মুহিন। খেতে বসলে পাশে বসে খাবার খুঁটে খুঁটে খায় পায়রাটা। সকালে মশারির ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে রেজাউলের বুকের কাছে, চুপ করে বসে থাকে। ঠোঁট ঘষে, বাক-বাকম শব্দ করে রেজাউলের কাছে নিজের সন্তানের মতোই আদর চায় মুহিন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *