জালালী কবুতরের কিছুকথা

'জালালের জালালী কৈতর'
‘ঝাঁকে উড়ে আকাশজুড়ে, দেখতে কী সুন্দর, জালালের জালালী কৈতর’…। হ্যাঁ, হজরত শাহজালালের কৈতর (কবুতর) এখনও ঝাঁকে ওড়ে। ৬০০ বছর ধরে স্বমহিমায় ওড়াউড়ি করছে এ ঘর থেকে ও ঘর, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী উড়বেও। শান্তির প্রতীক এই জালালী কৈতর যেন কালের অলঙ্কার। এই কৈতর ও শাহজালালের আধ্যাত্মিকতা যেন একই সূত্রে গাঁথা। সে কারণে কৈতর হারিয়ে যেতে পারে না বলে বিশ্বাস করেন সিলেটের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। শাহজালালের সঙ্গী এই কবুতর ‘জালালী কৈতর’ নামেই পরিচিত। কালের পরিবর্তনে সংখ্যা কমে এলেও কৈতরের বিশেষ রঙ পরিবর্তন হয়নি। হয়নি তার আবাস পরিবর্তন। শাহজালালের মাজারকে ঘিরে এসব কৈতরেরই অবস্থান। ঐতিহ্য আর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক এই কৈতর পর্যটকদেরও মুগ্ধ করে আসছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৩০১ সালে ইসলাম প্রচারে ইয়েমেন থেকে হজরত শাহজালাল (রহ.) ভারতের দিলি্লতে আসেন। সেখানকার অলি নিজাম উদ্দিন আউলিয়া শাহজালালের আধ্যাত্মিক শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে নীল ও কালো রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার দেন। ১৩০৩ সালে শাহজালাল ৩৬০ সফরসঙ্গী নিয়ে শ্রীহট্ট (সিলেটের প্রাচীন নাম) জয় করতে বাংলায় আসেন। জনশ্রুতি রয়েছে, শ্রীহট্ট জয়ের প্রতীকস্বরূপ কবুতর দুটিকে উড়িয়ে দেন হজরত শাহজালাল। সেই থেকে কবুতরগুলো মাজারটিলায় বসবাস শুরু করে। পরে ওই দুটি কবুতরের বংশধররাই ‘জালালী কৈতর’ নামে পরিচিতি পায়।
হজরত শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, শাহজালালের ভাগ্নে হযরত শাহপরান কবুতর খেতে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি প্রতিদিন একটি করে কবুতর
খেতেন, যার মধ্যে জালালী কবুতরও থাকত। কবুতরের পালকগুলো ফেলে না দিয়ে তিনি জমিয়ে রাখতেন। একদিন জালালী কবুতরের সংখ্যা কম দেখে শাহজালাল খাদেমদের কাছ থেকে জানলেন ভাগ্নের কবুতর খাওয়ার ঘটনা। শাহজালাল (র.) কিছুটা রাগ করেন। এতে ভাগ্নে হযরত শাহপরান (র.) মামাকে বললেন, ‘আমি আপনার কবুতরগুলো ফেরত দিচ্ছি।’ এরপর রেখে দেওয়া পালকগুলো আকাশে উড়িয়ে বললেন, ‘যাও! আল্লাহর হুকুমে শাহজালালের দরবারে পেঁৗছে যাও।’ সঙ্গে সঙ্গে পালকগুলো কবুতর হয়ে তার মামার দরবারে এসে হাজির হলো। সেই থেকে কেউ জালালী কবুতরগুলো খায় না।
৬০০ বছর ধরে জালালী কবুতরের অবস্থান শুধু দরগাহ এলাকায় নয়- সিলেটের আকাশজুড়ে অবাধে বিচরণ করছে এসব কৈতর। বিশেষ করে পুরনো স্থাপনা, মসজিদ, মন্দির এমনকি অনেক বাসা-বাড়ির নিরিবিলি জায়গাটুকু তাদের নিরাপদ ঠিকানা ছিল। কালের বিবর্তনে কবুতরের সংখ্যা কমে আসছে। বর্তমানে হাজারখানেক কবুতর টিকে আছে। সঠিক আবাস না থাকা এবং দেশীয় কবুতরের যন্ত্রণায় জালালী কৈতরগুলো পড়েছে সংকটে। প্রতিদিন দরগার মাঠে ও পাশের দালানগুলোতে এসব কবুতর দেখতে পাওয়া যায়। দেশ-বিদেশ থেকে মাজার জিয়ারতে আসা পর্যটকরা বাকবাকুম শব্দ আর ওড়াউড়িতে মুগ্ধ হন। তারা ধান ও চাল বিলিয়ে দেন কবুতরের খাবারের জন্য। খুব কাছ থেকে তাদের খাবার দিতে পর্যটকরা আনন্দও পান। ইকো-ফ্রেন্ডলি পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়ায় কৈতরের প্রজনন কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট জেলা কমিটির সেক্রেটারি আবদুল করিম কিম। মাজারের মোতওয়ালি্ল ফতেহ উল্লাহ আমান দিনদিন কবুতরের সংখ্যা কমছে জানিয়ে বলেন, মাজারের বিভিন্ন দালানে বক্স করে তাদের বসবাসের জন্য রাখা হয়েছে। দেশীয় কবুতর অনেক সময় জালালী কৈতরকে তাড়া করে। আমরা সে বিষয়টি নজরে রেখে বসবাস নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তিনি কৈতরগুলোকে নিয়মিত ওষুধ সেবন করানোর কথা জানান।
লেখক-অধ্যাপক সালেহ আহমদ জানান, কবুতরগুলো শত শত বছরের অলঙ্কার। দিনদিন সংখ্যা কমলেও এরা হারিয়ে যাবে না। কারণ তা শাহজালালের আমানত। এক সময় আকাশে তাদের বিচরণ ছিল দেখার মতো। সে জন্য স্থানীয় শিল্পী ও গীতিকার আবদুল হামিদ ‘ঝাঁকে উড়ে আকাশজুড়ে, দেখতে কী সুন্দর, জালালের জালালী কৈতর…’ গানটি লিখেন। তিনি জানান, অনেক কবুতরে রঙের পরিবর্তন এসেছে। দেশীয় কবুতরগুলো তাদের সঙ্গে বসবাস করায় এ পরিবর্তন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *