পায়রা থেকে ডাকপিয়ন

পায়রা থেকে ডাকপিয়ন চিঠিপত্রের বাহক।
(পায়রা মানব)

বর্তমান যুগ তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেটে ছেয়ে গেছে সারা পৃথিবী। তাই বলে কি ডাকঘর আর ডাকপিয়নরা বসে আছে? না। তারা তাদের মতো কাজ করে চলেছেন নিরন্তর। উল্লেখ্য, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে চিঠিপত্র চলাচলের ভূমিকা অনবদ্য ও অনস্বীকার্য। সেই প্রচীনকাল থেকে আজকের মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে অনেক কিছুরই অবদান রয়েছে। তার মধ্যে চিঠিপত্র চলাচলের ব্যবস্থা হচ্ছে অন্যতম। কাছের অথবা দূরের, একের সাথে অপরের যেকোনো ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে চিঠিপত্রের আদান-প্রদানই হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম ব্যবস্থা। সত্যি বলতে কি, সভ্যতার ক্রমবিকাশে যদি চিঠিপত্র চলাচল তথা ডাক ব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে কেমন হতো? সভ্যতা বা মানব সমাজের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ে যেতো। ভাবাবেগে আপ্লুত মানুষের হৃদয় হাহাকার করে ফিরতো। আজকের আমাদের দেশের ডাক বিভাগের যে প্রতীক- একজন রানার বা ডাক পিয়ন খালি পায়ে ঘুঙুর পরে হাতে বর্ষা ও হারিকেন আর পিঠে চিঠিপত্রের ঝুলি নিয়ে দৌড়াচ্ছে- সেটা দেখে বুঝার উপায় নেই এক সময় কত বিপদসঙ্কুল বনপথ দিয়ে এদের রাস্তা অতিক্রম করতে হতো একজনের চিঠি আরেকজনের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, সেকালে ডাক পিয়ন তথা রানারের প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল কবুতর। পায়রাজাত পাখিরা সহজে পোষ মানে ও বহুদূর ভ্রমণ করতে পারে বটে, তবে তারা কেবল জানা গন্তব্যেই যেতে পারে। চীনারা যিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্ব থেকেই বার্তাবাহক হিসেবে কবুতরকে ব্যবহার করতো। প্রেরিতব্য চিঠি একটি চোঙার মধ্যে রেখে সেটি কবুতরের পুচ্ছের ওপরে মাঝখানের পালকে বেঁধে রাখা হতো আর শিকারি পাখির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পুচ্ছে বাঁশি অথবা ঘণ্ডা লাগানো থাকতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরবরা এই কবুতরের মাধ্যমে চিঠিপত্র চলাচলকে একটি উঁচু শ্রেণির বিদ্যায় পরিণত করে দেখেছিলেন। সেটা আজ কেবলই ইতিহাস। যাহোক, মানুষ ক্রমশ প্রয়োজনের তাগিদে ডাকপিয়ন বা রানারের মাধ্যমে দ্রুতগতিসম্পন্ন চিঠিপত্র চলাচলের ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হলো। চীনদেশ, পারস্য ও ভারতে রিলে ব্যবস্থা চালু হলো। রিলে ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম ছিল ঘোড়া। পারস্য সম্রাট সাইরাস হিসাব কষে তার বিরাট সাম্রাজ্যজুড়ে কতগুলো রিলে স্টেশন স্থাপন করে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক স্টেশনে পত্রবাহকের জন্য নতুন ঘোড়া থাকতো আর তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাক বিলি করতে হতো। গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডটাস এই পদ্ধতির প্রশংসা করে বলেছিলেন, বৃষ্টি, বরফ, উষ্ণতা কিংরা রাতের বিভীষিকা এসব বার্তাবাহককে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ইউরোপ আমেরিকা ও এশিয়াতে চিঠিপত্র চলাচলের বহু কেন্দ্র স্থাপিত হয়। তখন খরচ পড়তো অনেক এবং বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য খরচ ছিল ভিন্ন। প্রাচীন চীন, পারস্য, মিসর, গ্রিস আর ইউরোপের মধ্যে রোমে মৌখিক ডাকের প্রচলন ছিল।

মুখে বলে দেয়া হতো বক্তব্য, দূত সেটা মুখে মুখেই পরিবেশন করে দিত। লেখালেখির চলও ছিল ব্যয়বহুল। ডাকপিয়নরা ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে ছোটাছুটি করতেন। তাছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের আমলে ডাক ব্যবস্থার বিরাট উন্নতি হয়। তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একটা বিশেষ বাহিনীই গড়ে তোলা হয় তখন। ইতিহাসবিদদের মতে, রেকর্ড অনুযায়ী ডাকপিয়নরা দিনে-রাতে একটানা ঘোড়া চালিয়ে মোটামুটি ৭০ মাইল পথ পাড়ি দিতেন। সাধারণের জন্যও এই ব্যবস্থা উন্মুক্ত ছিল। লোকজন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো ছুটন্ত ডাকপিয়নের হাতে চিঠি ধরিয়ে দেয়ার জন্য। পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও এই ব্যবস্থা চালু থাকে। ৪৯৩ সাল থেকে ৫৬২ সাল পর্যন্ত ইতালির শাসক অস্ট্রোগথের রাজা থিয়েভেরিক আরো উন্নয়ন সাধন করেন ডাক ব্যবস্থার। আরবেও ঠিক একই সময়ে এই ধরনের ডাক ব্যবস্থা আরম্ভ হয়েছিল। যিশুখ্রিস্টের জন্মের দুশ বছর আগে মিসরের ভোগ শহরে পোস্টাল সিস্টেম চালু ছিল। নাইলো ভ্যালির পোস্ট অফিসের রেজিস্টারে খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালের চিঠিপত্তর আদান-প্রদানের রশিদ, মেইল সংখ্যা আর নাম ঠিকানার রেকর্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের ৫০ বছর পর খলিফা মুয়াবিয়া আরবের ডাক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বড় বড় ছয়টা রাস্তার ধারে প্রতি ১৫ মাইল পর পর প্রায় একশটার মতো ডাকঘর অফিস স্থাপন করা হয় তখন। ডাকপিয়নরা ঘোড়া আর উটের পিঠে চড়ে খবর আদান-প্রদান করতেন ১২৫০ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত। শাসনকর্তা তুঘলক সুলতান চালু করেন এয়ার মেইল সার্ভিস। পায়রাকে ট্রেনিং দিয়ে পায়ে চিঠি বেঁধে দিয়ে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হতো। আমাদের পাক ভারত উপমহাদেশে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আমলেই (খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সাল) চালু হয় পায়রা দিয়ে সংবাদ পরিবহন। তার রাজধানী পাটালীপুত্র (এখন বিহারের পাটনা) ছিল এ ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের নাতি সম্রাট অশোক ডাক বিভাগের ভালো উন্নতি করেন। মোগল আমলেও তা বজায় থাকে। বিখ্যাত আরব বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার লেখায় পাওয়া যায়, ডাকপিয়নরা পায়ে হেঁটে খবর পরিবহন করতো। ১৫২৭-১৫৩০ সম্রাট বাবর আগ্রা থেকে কাবুল পর্যন্ত প্রতি ৩৬ মাইল পর পর একটা করে ডাকঘর স্থাপন করেন। সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) প্রতি ১০ মাইল পর পর প্রতিটা সাব স্টেশন স্থাপন করে তাতে দুটো ঘোড়া আর ক’জন করে ডাকপিয়ন থাকার ব্যবস্থা করেন। খবর এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যেত চেইন সিস্টেমে। উপমহাদেশের ডাক ব্যবস্থার বিপ্লব সাধন করেন সম্রাট শেরশাহ (১৫৪০-১৫৪৫) তিনি চালু করেন ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা। তার আমলেই গোটা সাম্রাজ্য ঘোড়া আর ডাকপিয়নদের নিয়ে ডাক ব্যবস্থার একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, ১৮৩৭ সালে ডাকের নতুন আইন প্রবর্তিত হয়। এই আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতাধীন সমস্ত জায়গায় ডাকবহনের কর্তৃত্ব এককভাবে সরকারের ওপর ন্যস্ত হয় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডাক নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক ডাক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় লর্ড ডালহৌসির শাসন আমলে (১৮৪৮-৫৬)। ১৮৫০ সালে ডাক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য তিন সদস্য নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৫৪ সালে বর্তমানে প্রচলিত ডাক ব্যবস্থার কাঠামো স্থির হয়। উল্লেখ্য, ডাকঘরের প্রধান কাজ প্রাপকের কাছে চিঠি বিলি করা হলেও পরে অনুরূপ আরো অনেক কাজ এর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮৮৩ সালে টেলিগ্রাফের কাজও এর মাধ্যমে শুরু হয়। এছাড়া ভি.পি. পার্সেল, মানি অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার বিক্রয়, সেভিংস ব্যাংক, মেয়াদি সঞ্চয় সার্টিফিকেট বিক্রয়, জীবন বীমা ইত্যাদি কাজও ডাকবিভাগের আওয়াভুক্ত। ডাক বিভাগ প্রাপকের কাছে দ্রুত চিঠি পৌঁছে দেয়ার কাজে সর্বদা তৎপর। যানবাহনের উন্নতি এই কাজকে দ্রুততর করেছে। যেমন এখন আকাশযান, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি এবং জাহাজ প্রভৃতি এই কাজের সহায়ক। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে ভারতেই প্রথম ১৯১১ সালে ডাক বহনের জন্য আকাশযান ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বর্তমানে চিঠিপত্র বাছাইয়ের কাজ এবং বিলি করার কাজ সহজতর করার জন্য সব উন্নত দেশে পোস্টাল কোড উদ্ভাবিত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় দেশের প্রতিটি ডাকঘরের জন্য একটি কোড নম্বর নির্ধারিত হয়। খামের ওপর প্রাপকের নাম ঠিকানার সাথে চিঠি বিলিকারী ডাকঘরের কোড নম্বরটি উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশেও এই পোস্টাল কোড প্রণালী চালু হয়েছে। একেক দেশের ডাকপিয়নরা চিঠিপত্র বা দ্রব্যসামগ্রী প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য একেকভাবে বয়ে নিয়ে যান। ফ্রান্সের ডাকপিয়নরা ছোট স্যুটকেসে করে চিঠিপত্র ও দ্রব্যসামগ্রী বহন করেন। স্পেনের ডাকপিয়নরা ডাক বিলির কাজ করেন বাইসাইকেলে চেপে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাকপিয়নরা এক হাতে ঠেলে নেয়া যায় চার চাকার এমন এক ধরনের ছোট গাড়ি ব্যবহার করেন। আবার মরু অঞ্চলের ডাকপিয়নদের বাহন হলো উট। বহু উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে ডাক ব্যবস্থাপনা এগিয়ে চললো ইতিহাসের পাতায়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেদিনের সেই অনুন্নত ডাকব্যবস্থা অধিকতর উন্নত পর্যায়ে উপনীত হলো। উপসংহারে এ কথা বলা যায়, সভ্যতা যতোই এগুক আর মেইল ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, মোবাইলের যতোই প্রসার ঘটুক, ডাকযোগে চিঠিপত্রের চলাচল কিছুতেই চিরতরে বন্ধ হবে না। কারণ, এর আবেদন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *